প্রকাশিত: Sun, Jun 25, 2023 11:16 PM
আপডেট: Tue, Jun 24, 2025 5:48 AM

ডিগ্রির ছুতায় মানুষের সাংবাদিকতা করার অধিকার কেড়ে নেওয়ার চিন্তা বাদ দেন

আর রাজী, ফেসবুক থেকে: একটা কথা কানে আসছে ঘুরে ফিরে- সাংবাদিকতা করতে হলে কম করে ডিগ্রি পাস (গ্র্যাজুয়েট) হতে হবে বা একজন সাংবাদিককে অন্তত ডিগ্রি পাস হতেই হবে। এই চিন্তা যাঁদের মাথায় এসেছে তাঁরা হয় অতিসরলমতি নইলে গণশত্রু। 

ধরুন, আমি আর রাজী, লেখাপড়া করি নাই, বাবার হোটেলে খাইদাই আর ঘুরে বেড়াই। বয়স যখন পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই, মনে হইলো- এই দেশের মানুষের মুক্তির জন্য সবার আগে দরকার মানুষকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলা। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, কেন আমার লেখাপড়া হলো না, আমি অনুধাবন করতে পারি কীভাবে আমার পরিববার আমাকে পড়ালেখার চাপ দিয়ে পড়ালেখা থেকে বিদায় করে দিয়েছে, আমি বুঝতে পারি স্কুল-কলেজের বর্তমান শিক্ষাপদ্ধতি শিশুদের জন্য কতোটা ক্ষতিকর। ইত্যাদি ইত্যাদি অনুধাবন থেকে আমার দৃঢ় প্রত্যয় জন্মেছে যে এমন একটা সংবাদমাধ্যম দরকার যার একমাত্র কাজ হবে শিশু-শিক্ষার খবরাখবর এমনভাবে তুলে ধরা যেন একটি শিশুও তার শিক্ষাজীবন থেকে বঞ্চিত না হয়। আমার টাকা নাই তবে অপ্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা আছে, আমি প্রায় রবীন্দ্রসম প্রতিভা ধরি, কী করতে হবে আমি জানি, কিন্তু আমি যেহেতু ডিগ্রি পাস নই সুতরাং আমি নিজে এই কাজ করতে পারবো না। কারণ এই কাজের নাম হয়ে গেছে সাংবাদিকতা। ডিগ্রি ছাড়া তো সাংবাদিকতা হবে না, সাংবাদিক হওয়া যাবে না।

ধরেন, তসলিমা বেওয়া লেখাপড়া করেন নাই, স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে ইপিজেডের এক বস্ত্রকারখানায় কাজ করে চলেছেন। বয়স হয়েছে। এখন তাঁকে চাকুরি ছাড়তে হবে। উনার মনে হলো, চাকুরি শেষে উনি গার্মেন্টেসের মেয়েদের জন্য, তাদের জীবন, তাদের দুঃখকষ্ট, দাবিদাওয়া, বস্ত্রদুনিয়ায় কোথায় কী হচ্ছে, তাদের বাচ্চাকাচ্চাদের জন্য কী করা দরকার, তাদের স্বাস্থ্য ইত্যাদি তুলে ধরার জন্য সংবাদপত্র করবেন। কিন্তু তিনি তা করতে পারবেন না, কারণ দেশের আইনানুযায়ী সাংবাদিকতা করতে হলে ডিগ্রি পাস হতে হবে। 

হে ডিগ্রিবাজ শিক্ষিত-বাঙালি, আপনাদের এই ডিগ্রিগিরি যে আগামী দিনের কাজী নজরুল ইসলামকেও সাংবাদিকতায় ঢুকতে দিবে না তা কি বুঝতে পারেন?

সভ্য গণতান্ত্রিক সমাজে একজন মানুষের মুখও যেন বন্ধ না হয়ে যায় তার জন্য শত আয়োজন করা হয়েছে, হচ্ছে। সভ্য সমাজে একটা দুর্বল ক্ষীণ কণ্ঠও যদি তার কথা বলতে চায়, তার মতো করে সাংবাদিকতা করতে চায় সেই পথ যুগে যুগে প্রসারিত হয়েছে, হচ্ছে। বাংলাদেশের সংবিধানের মতো খারাপ সংবিধানেও মানুষের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা স্বীকৃত হয়েছে। আর এই দেশেরই কিছু শিক্ষিত-বাঙালি সাংবাদিকতার অধিকারকে তথাকথিত ডিগ্রিধারীদের করতলে বন্দী করতে কুযুক্তি দিয়ে বেড়াচ্ছেন! 

এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকের একাধিক সম্পাদক (মনে রাইখেন- সম্পাদক) কর্মরত আছেন যঁদের ডিগ্রির প্রকৃত সনদ নাই বলে বহুল প্রচারিত। অনুমান করি কথা সত্য। কিন্তু তাঁরা প্রচলিত অর্থে দারুণভাবে সফল সম্পাদক। আর কতো শত প্রতিথযশা সাংবাদিককে যে চিনি-জানি যাঁরা ডিগ্রি পাস দেননি বা দিতে যাননি- সে কথার উল্লেখ করা বাহুল্য মাত্র।

তথাকথিত শিক্ষিত সম্প্রদায় এই দেশের সাধারণ মানুষের অধিকার নানান ছলেবলেকৌশলে খাইয়া ফেলাইতেছে। এই দেশে ডিগ্রিধারীরা যে পরিমাণ অসৎ, দুর্নীতিবাজ, চরিত্রহীন ততোাখানি বোধকরি ডিগ্রিহীন সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষরা নন। অথচ এইসব ডিগ্রিধারী দুষ্টুগুলো সাধারণ মানুষের সন্তানদের সাংবাদিকতায় আসার সুযোগ আরও এক দফা নস্যাৎ করার চক্রান্তে লিপ্ত হইছে।

ভাইলোক, এই দেশে সাংবাদিকতা শিক্ষার একটি প্রতিষ্ঠানও আজ পর্যন্ত গড়ে ওঠে নাই। যাঁরা আপনাদের বলেন, তাঁরা সাংবাদিকতায় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ালেখা করেছেন, তাঁরা অর্ধসত্য বলেন। কারণ, বাংলাদেশের কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রধান বিষয় হিসেবে সাংবাদিকতা পড়ানো হয় না। সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ বা ম্যাস কমিউনিকেশন হচ্ছে প্রধান পাঠ্য, শিক্ষকদেরও অধিকাংশ গণযোগাযোগ বিষয়ে পাঠ দেন, গবেষণা করেন। কিন্তু সমাজের কাছে তাঁরা অনেকেই এই সত্য গোপন করে নিজেদের সাংবাদিকতার শিক্ষক, সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে পাস করেছি- ইত্যকার অর্ধসত্য, প্রকৃতপ্রস্তাবে মিথ্যা বলে ফাঁপর নেন। কথা হচ্ছে, সাংবাদিকতা করার জন্য সাংবদিকতায় উচ্চ শিক্ষা জরুরি নয়, যা জরুরি তা হচ্ছে সাধারণ মানুষের প্রতি দরদ ও সততা। কিন্তু আমার মতো এই সব পাস করাদের সততা ও দরদের যে কি হাল তা তো বাংলাদেশের শিক্ষিতদের চেহারাসুরত আচারআচরণ জীবনযাপন বা স্বৈরতোষণ দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যায়। 

নিশ্চয়ই জানেন, যাঁরাই সাধারণ মানুষের পক্ষে কথা বলতে পারেন, যাঁরাই সাধারণ মানুষের কথা বলতে চান, এমন কি যে কেবল নিজের কথা বা মত প্রচার করতে চান ডিগ্রিফিগ্রিসহ যে কোনো শর্তে  তাঁর বা তাঁদের অধিকারে হস্তক্ষেপের চিন্তা মানুষের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। নিঃসন্দেহে শিক্ষিত-বাঙালির এই কুচিন্তা তার আত্মরতিমাখা নিম্নরুচির জঘন্য অহমিকাজাত। 

সুতরাং, ডিগ্রির ছুতায় মানুষের সাংবাদিকতা করার অধিকার কেড়ে নেওয়ার চিন্তা বাদ দেন। সাংবাদিকতা কোনো লাইসেন্সি পেশা না। পৃথিবীর কোনো সভ্য ও/বা গণতান্ত্রিক দেশেই অনুমতি নিয়ে কেউ সাংবাদিকতা করে না। যে কোনো মানুষ যখন ইচ্ছা তখন সাংবাদিকতা করবে এবং যখন ইচ্ছা সাংবাদিকতা থেকে দূরে সরে যাবে- এই হচ্ছে সাংবাদিকতা বিকাশের মৌলিক শর্ত, এ মানুষের মৌলিক অধিকার।

আপনারা যাঁরা সাংবাদিকতাকে চাকুরি বানিয়ে ফেলেছেন তাঁরা চাকরি করতে থাকেন, আপত্তি নাই কিন্তু যারা সাংবাদিকতাকে পেশা বানাতে চায় না তাদের অধিকারে মাথা ঢুকাইতে আইসেন না। তাদের গিলটিনে কিন্তু আপনার মাথা কাটা যাবে।